মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ এবং সমাধান

মানসিক রোগ কি এবং কারা, কি এর লক্ষণ এবং চিকিৎসা

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মানসিক রোগে ভুগছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেকেই এসব রোগের লক্ষণ গুলো কে বুঝতে পারেন না, অথবা লজ্জা ও ভয়ের কারণে চিকিৎসা সহায়তা নিতে দেরি করেন।

 

তাই আজকের এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ সম্পর্কে, যা আপনার নিজের বা আপনার পরিচিত মানুষের জন্য অনেক হেল্পফুল হবে।

 

কিন্তুু মনে রাখবেন, এই লক্ষণ গুলো কোনো মানসিক রোগের শতভাগ ইঙ্গিত নয়। তবে, যদি আপনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই লক্ষণ গুলোর কোনটি দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করার চেষ্টা করবেন। তো চলুন এবার তাহলে মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ গুলো জেনে নেওয়া যাক। 

মানসিক রোগ কি?

মানুষের জীবনে শারীরিক সুস্থতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানসিক সুস্থতাও একইভাবে অপরিহার্য। শরীর যেমন রোগাক্রান্ত হতে পারে, তেমনি মনও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে পারে। আর এইসব সমস্যাকে বলা হয় মানসিক রোগ। মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো অনেক সময় স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ, অস্বাভাবিক রাগ, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের অভাব, একাকীত্ববোধ এসব মানসিক রোগের  লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

আর মানসিক রোগের কারণ ব্যক্তিভেদে এবং পরিবেশগত বিষয়ের উপর নির্ভর করে। জৈবিক কারণ, বংশগত ঝুঁকি, মানসিক চাপ, আঘাতমূলক ঘটনা, পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এসব কারণ মানসিক রোগের জন্য দায়ী।

কাকে বা কাদেরকে মানসিক রোগি বলা হয়?

মানসিক রোগ হলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটানো এমন এক ধরণের অসুস্থতা যা একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, সাইকোসিস, বাইপোলার ডিসঅর্ডার – এগুলো সবই মানসিক রোগের অন্তর্গত। আর যখন আমরা কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ গুলো অস্বাভাবিক হারে দেখতে পারবো, তখন তাকে আমরা মানসিক রোগি বলে চিহ্নিত করলেও কোনো ভুল হবেনা। 

আসুন জেনে নেয়া যাক মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো

মানুষের মন হলো জটিল এক রহস্য। আবেগ, চিন্তাভাবনা, স্মৃতি – সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় এক অপার্থিব জগৎ। কখনো কখনো এই জগতের ভারসাম্য হারিয়ে যায়, দেখা দেয় মানসিক রোগের ছায়া। আর এই অসুস্থতার লক্ষণ শুধুমাত্র মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং শরীরেও বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। এরকম কিছু মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

১) একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা

মানুষ স্বভাবতই সামাজিক প্রাণী। প্রিয়জনের সাথে মেলামেশা, আড্ডা, কথা বলা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যখন একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সকলের থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখে, বন্ধুবান্ধব, পরিবার এমনকি প্রিয়জনের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দেয়, তখন এটি একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ হয়ে যায়। বিষণ্ণতা, সামাজিক উদ্বেগ, এমনকি কিছু আত্ম-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব ব্যাধির লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।

০২) দীর্ঘস্থায়ী মন খারাপ থাকা

মন খারাপ বা বিষণ্ণতা মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষণ। তবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যদি এই মন খারাপের অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে আপনার অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। ক্রমাগত বিষণ্ণতা, আনন্দহীনতা, হতাশা, ক্লান্তিবোধ এসব মানসিক রোগের ইঙ্গিত বহন করে। আর যদি আপনি কোনো ব্যক্তির মধ্যে এমন লক্ষন দেখেন তাহলে বুঝতে হবে যে, সেই ব্যক্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। 

০৩) স্বাভাবিক কথা বলতে অনীহা

যারা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন তারা অনেক সময় অন্যদের সাথে কথা বলতে একেবারেই অনিচ্ছুক হয়ে পড়েন। অনেকেই সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বোধ করেন। তারা ভয় পান যে, অন্যরা তাদের সমালোচনা করবে, তাদের কথা উপহাস করবে, অথবা তাদের সাথে মিশতে চাইবে না। নীচু আত্মসম্মানও এই অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।

 

কিছু লোক মনে করেন যে, অন্যদের সাথে মিশলেই তারা আরও বেশি একাকী বোধ করবেন। কারণ, তারা অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবেন না, অথবা তাদের আবেগ প্রকাশ করতে পারবেন না। কারণ, মানসিক অসুস্থতায় মস্তিষ্কের নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর ফলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় অস্বস্তি, ভয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা দেখা দিতে পারে।

০৪) অকারণে ঝগড়া করা

আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন যারা বিনা কারণে সবার সাথে ঝগড়া করতে পছন্দ করেন। পরিবারের সদস্য, বন্ধু, সহকর্মী, এমনকি অপরিচিতদের সাথেও তাদের তর্কবিতর্ক বা মনোমালিন্য দেখা যায়। প্রায়শই আমরা তাদেরকে “গরম মেজাজের” বা “অমানষিক” বলে চিহ্নিত করি। কিন্তু কি আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, এই অকারণে ঝগড়ার পেছনে আরও গভীর কোন কারণ থাকতে পারে?

 

আমরা সকলেই জীবনের কোন না কোন সময় রাগ অনুভব করে থাকি। কখনও কখনও এই রাগ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে আমরা চারপাশের মানুষের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ি। তবে, যদি আপনি দেখেন যে আপনি বারবার, অকারণেই সবার সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ছেন, তাহলে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ, অকারণে ঝগড়া শুধুমাত্র রাগের বহিঃপ্রকাশই নয়, বরং এটি অনেক গভীরতর মানসিক সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।

০৫) হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা

হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা, যা আমরা অনেক সময় ‘গরম হয়ে যাওয়া’ বলে থাকি, যা মানসিক রোগের একটি সাধারণ শারীরিক লক্ষণ। রাগ, বিরক্তি, অস্থিরতা – এইসব অনুভূতির তীব্রতা এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, শরীর কাঁপুনি, ঘাম, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা এমনকি বমি বমি ভাবের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

 

আমাদের মস্তিষ্কের ‘লিম্বিক সিস্টেম’ নামক অংশটি আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী। যখন আমরা খুব বেশি উত্তেজিত বোধ করি, তখন এই অংশে অতিরিক্ত রাসায়নিক নিঃসরণ হয়, যার ফলে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, পেশীতে টান, ঘাম হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তি, বমি বমি ভাব এমনকি মাথা ঘোরা দেখা দেয়।

০৬) গায়েবি আওয়াজ বা কথা শোনা

আমরা মানসিক রোগের অনেক লক্ষণ চিনতে পারি। যেমন: দুঃখ, উদ্বেগ, মনোযোগের অভাব, ঘুমের সমস্যা। কিন্তু কিছু লক্ষণ এমনও আছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কারণ এগুলো শারীরিক ভাবে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে একটি হলো গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া।

 

আর এই গায়েবি আওয়াজ শোনার অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো মৃদু ফিসফিস শব্দ শুনতে পায়, আবার কেউ কেউ স্পষ্ট কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়। কখনো কখনো এই আওয়াজ গুলো বন্ধুত্বপূর্ণ হয়, আবার কখনো হুমকির। অনেক সময় এই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ও আবেগের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে।

০৭) অকারণে মানুষকে সন্দেহ করা

মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা এবং সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য অন্যদের সাথে বিশ্বাস ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু কখনও কখনও, এই বিশ্বাসের ভিত্তি একবারে ভেঙে পড়ে অবিশ্বাসের বিষাক্ত ছায়ায়। যখন এই অবিশ্বাস অকারণ, অমূলক এবং চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন এটি একটি মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরা দেয়।

 

অন্যদের অকারণে সন্দেহ করা হলো এমন একটি লক্ষণ যা বিভিন্ন মানসিক রোগের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো প্যারানয়ড ডিজঅর্ডার। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মনে করেন যে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, তাদের নজরদারি করা হচ্ছে, তাদের ক্ষতি করা হবে। তারা বন্ধু, পরিবার, এমনকি অপরিচিতদেরও সন্দেহ করে থাকে।

০৮) প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করা

মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ গুলো অনেক সময় এতটাই সূক্ষ্ম এবং অস্পষ্ট হয় যে আমরা সে গুলো কে সাধারণ শারীরিক সমস্যা বলে ভুল করে ফেলি। এর মধ্যে একটি হলো ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি অমনোযোগিতা।

 

নিয়মিত গোসল করা, দাঁত মাজা, পোশাক পরিবর্তন করা – এসব মৌলিক কাজ গুলো বাদ দেওয়া, শরীরের যত্ন না নেওয়া – এগুলো মানসিক অসুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। মানসিক অসুস্থতার প্রভাবে একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং আচরণে ব্যাঘাত ঘটে। হতাশা, উদ্বেগ, অসহায়ত্ব বোধের কারণে তারা নিজেদের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।

০৯) আনন্দের অভাব দেখা দেওয়া 

আমাদের জীবনে আনন্দ যেন এক অপরিহার্য সঙ্গী। প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো, শখ পূরণ, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ – এসব কিছুই আমাদের মনে আনন্দের স্পন্দন জাগিয়ে তোলে। কিন্তু যখন এই আনন্দের স্পন্দন থেমে যায়, তখন জীবন হয়ে পড়ে একাকী, রঙহীন।

 

এই আনন্দের অভাব কেবল মন খারাপের লক্ষণ নয়, বরং এটি আপনার জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা ও হতে পারে। কারণ, আনন্দের অভাব অনেক সময় মানসিক রোগের একটি লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।

 

কল্পনা করুন, আপনার প্রিয় বইটি হাতে নিয়ে বসেছেন, কিন্তু পাতা গুলো যেন মৃত মনে হচ্ছে। আপনি আপনার প্রিয় গান শুনছেন, কিন্তু মনে কোন তরঙ্গ নেই। এমনকি, প্রিয়জনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, তবুও মন যেন কোথায় অন্যত্র অনুভব হচ্ছে। তো এই অনুভূতি গুলো কি আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে?

 

হ্যাঁ, এ গুলোই হতে পারে আপনার আনন্দের অভাবের লক্ষণ। যেসব কাজে আগে আনন্দ পেতেন, এখন সে গুলো তে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। শখ গুলো যেন ম্লান হয়ে যায়, নতুন কিছু শুরু করার উৎসাহও থাকে না। আর সমস্যা গুলোর ফলে শুরু হয় আমাদের মানসিক সমস্যা। 

১০) সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া

মানসিক চাপের প্রভাবে মস্তিষ্কের ‘হাইপোথ্যালামাস’ নামক অংশটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে শরীরে ‘করটিসল’ নামক হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। করটিসল দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপের জন্য দায়ী। এই হরমোনের প্রভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, পেশীতে টান ধরে, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয় এবং হজমশক্তিও নষ্ট হতে পারে।

 

মানসিক চাপের ফলে সৃষ্ট শারীরিক অসুস্থতা অনেক সময় মানুষকে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে তারা বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে মিশতে অসুবিধা বোধ করে। এছাড়াও, মানসিক চাপের ফলে বিরক্তি, মেজাজ খারাপ, দুঃখ ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ দেখা দেয়। এর ফলে মানুষের সাথে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।

১১) স্বাভাবিক ঘুমের মাত্রার ব্যাঘাত

ঘুম, আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে, নতুন শক্তি দিয়ে আমাদের শরীর ও মনকে করে তোলে প্রফুল্ল। কিন্তু যখন ঘুমের নিয়ম ব্যাহত হয়, তখন শুরু হয় নানা সমস্যা। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ।

 

ঘুম অস্বাভাবিক কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, মানসিক রোগের একটি সাধারণ লক্ষণ। অনিদ্রা নামে পরিচিত এই সমস্যায় রাতে ঘুম না হওয়া, দ্রুত ঘুম ভেঙে যাওয়া, ঘুম থেকে না উঠে থাকার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আবার অতিরিক্ত ঘুম, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, উন্মাদ, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক রোগের লক্ষণও দেখা দিতে পারে। আর যদি এমনটা হয়, তাহলে তাকে মানসিক রোগের লক্ষন হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে।

মাানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায়

মানসিক রোগ – শব্দটি শুনলেই মনে হয় যেন জীবনের আলো নিভে যাচ্ছে। ভয়, হতাশা, অন্ধকার – এসব ভাবনা মনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। মনে রাখবেন, মানসিক রোগ কোনো অসম্ভব কিছু নয়। কারণ সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে, আপনিও এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন, আর আপনি অন্যান্য মানুষের মতো আলোর পথ খুঁজে নিতে পারবেন।

০১-পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে

মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণের অনেক উপায় আছে, আর এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো পলায়ন না করে পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া। অনেক সময় আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাই, কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু পলায়ন করা কখনোই দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়। বরং এটি মানসিক দ্বন্দ্ব, অপরাধবোধ এবং নেতিবাচক চিন্তা ভাবনার জন্ম দিয়ে থাকে। তাই প্রথমেই যেকোনো মানসিক সমস্যাকে বাস্তবতার অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া জরুরি।

০২-অতীত কিংবা ভবিষ্যত ভুলে বর্তমানে মনোযোগ

অতীতের ভুল, হতাশার স্মৃতি, অপূর্ণ ইচ্ছা – এসব যেন আমাদের মনে কালো মেঘ হয়ে ভেসে বেড়ায়। অতীতের হিসাব-নিকাশ, আফসোস, ক্ষোভ – এসব আমাদের মানসিক শান্তি ছিনিয়ে নেয়। অন্যদিকে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, অজানা ভয় আমাদের মনে তৈরি করে অস্থিরতা।

 

এই দুই চিন্তার বেড়াজালে আটকে পড়ে আমরা বর্তমানকে ভুলে যাই। হাতের কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। ব্যর্থতার ভয়ে ভীত থাকি। আর এই ভয়, হতাশা ধীরে ধীরে আমাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে।

 

তাই অতীতের কথা ভুলে বর্তমান সময়ে মনোযোগ দিন। বর্তমান সময়েই জীবনের সব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করুন, প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটান, আপনার পছন্দের কাজ করুন। বর্তমান মুহূর্তে পূর্ণ মনোযোগ দিলেই মনের শান্তি আসবে।

০৩-পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খাওয়া

আমাদের মস্তিষ্ক হল শরীরের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। আর মস্তিষ্কের সুস্থতা নির্ভর করে সঠিক খাদ্যের উপর। ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট – এই সকল পুষ্টি উপাদান মস্তিষ্কের সুস্থ কার্যকারিতা বজায় রাখে। নিয়মিত ফল, শাকসবজি, বাদাম, বীজ, মাছ, ডিম খাওয়ার মাধ্যমে এই পুষ্টি উপাদান গুলো সহজেই আমাদের শরীরে প্রদান করা সম্ভব।

 

সেরোটোনিন – মেজাজের নিয়ন্ত্রণে এই নিউরো ট্রান্সমিটারের ভূমিকা অপরিসীম। যখন সেরোটোনিন এর ঘাটতি দেখা দেয়, তখন বিষণ্ণতা, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ট্রাইপটোফ্যান সমৃদ্ধ খাবার – যেমন, দুধ, ডিম, টার্কি, চিকেন – সেরোটোনিন উৎপাদনে সহায়তা করে। তাই নিয়মিত এই খাবার গুলো খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

০৪-পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো

ঘুমের অভাব মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন আমরা পর্যাপ্ত ঘুমাই না, তখন মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, নার্ভের কার্যকারিতা কমে যায় এবং চাপের প্রতি সহনশীলতা কমে যায়। এর ফলে বৃদ্ধি পায় উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং চাপের মাত্রা। ঘুমের অভাবে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং যুক্তি করার ক্ষমতাও কমে যায়।

 

অন্যদিকে, পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করে এবং ব্রেনের কাজ গুলোকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে। পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের নতুন কোষ তৈরিতে সহায়তা করে এবং স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, ঘুম আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, সেইসাথে চাপের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধি করে।

০৫-ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করা

ধর্মের প্রতি আগ্রতা মানুষকে এক ধরণের আশ্বাস, নিরাপত্তা এবং সমর্থনের অনুভূতি দিতে সাহায্য করে।  প্রার্থনা, ধ্যান, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ – এইসবের মাধ্যমে মানুষ এক ধরণের শান্তি এবং ভারসাম্য অনুভব করে। এছাড়াও, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ মানুষকে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।

 

তবে, ধর্মের প্রতি আনুগত্য সবসময় সকলের জন্য কার্যকরী হয় না। কিছু ক্ষেত্রে, ধর্মীয় বিশ্বাস মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো আরও খারাপ করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষ ভাবতে পারেন যে তাদের মানসিক সমস্যা গুলো ঈশ্বরের শাস্তি, যার ফলে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ এবং লজ্জার অনুভূতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

 

অন্যদিকে, ধর্মের প্রতি আনুগত্য মানুষকে জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ধর্মীয় নীতিবোধ মানুষকে নৈতিকভাবে জীবনযাপন করতে এবং ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে থাকে।

০৬) নিয়মিত ব্যায়াম করা

ব্যায়ামের সময় আমাদের শরীরে এন্ডোরফিন নামক একধরণের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়। এন্ডোরফিন মেজাজের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং আমাদের শরীরকে আরাম দেয়। ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত ​​সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, যা মস্তিষ্কের কোষ গুলোকে আরও ভালভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।

 

কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি), একজন মানুষকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে 150 মিনিট মাঝারি-তীব্রতা বা 75 মিনিট তীব্র অ্যারোবিক ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়। এতে হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো বা নাচ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। কিছু শক্তি প্রশিক্ষণ ব্যায়াম, যেমন ওজন তোলা, সপ্তাহে দু’বার করা উচিত।

০৭) ধুমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকা

ধুমপান ও মাদকাসক্তি শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। নিয়মিত ধুমপানকারীদের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য মানসিক রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। মাদকাসক্তি তো মানসিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ রূপ। এটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং আচরণের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও বিরূপ প্রভাব পড়ে।

 

ধুমপান ও মাদক ত্যাগ করা সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা এবং প্রয়োজনে পেশাদার পরামর্শের মাধ্যমে এই লড়াইয়ে জয়লাভ করা সম্ভব। ধুমপান ও মাদক ত্যাগের ফলে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যই উন্নত হয় না, বরং মানসিক অবস্থাও অনেক ভালো হয়। বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ কমে, মন প্রফুল্ল থাকে এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।

আপনার জন্য আমাদের কিছুকথা

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এছাড়াও মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলে কিভাবে পরিত্রান পাবেন সে সম্পর্কেও সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য অনেক হেল্পফুল হবে। আর যদি আপনি স্বাস্থ্য সম্পর্কে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো বিনামূল্যে পেতে চান তাহলে Omega Point এর সাথে থাকবেন। ধন্যবাদ, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।