ইয়াবার মরন ছোবল থেকে যেভাবে রক্ষা করবেন আপনজনকে

যখন মাদকাসক্তি সমাজের ক্ষতিকর রূপ ধারণ করেছে, তখন আমাদের প্রিয়জনদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদকের মরন ছোবল থেকে রক্ষা করা জরুরি। তাই এই প্রবন্ধে, আমরা ইয়াবার মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করব, এবং আপনি কিভাবে আপনার প্রিয়জনদের এই মাদকাসক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করব। তো যদি আপনি উক্ত বিষয় গুলো জানতে চান, তাহলে হাতে একটু সময় নিয়ে নিচের আলোচিত আলোচনায় চোখ রাখুন।

কোথা থেকে উৎপত্তি এই ইয়াবার? 

ইয়াবা, আজকের দিনের এক ভয়ঙ্কর মাদক, যার উৎপত্তি বেশ জটিল ও রহস্যময়। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ হিসেবে তৈরি করা হলেও, দীর্ঘ যাত্রার মাধ্যমে এটি পরিণত হয়েছে এক মারণাস্ত্রে। ১৯১৯ সালে জাপানে এস্ফিটামিন থেকে মেথএম্ফেটামিন তৈরির মাধ্যমে ইয়াবার যাত্রা শুরু হয়। নাকের বন্ধন দূর করতে এবং ব্রঙ্কিয়াল ইনহেলার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এই মিশ্রণ।

 

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, মেথএম্ফেটামিনের ব্যবহার নতুন মাত্রা পায়। আমেরিকা, ব্রিটেন এবং জার্মানি তাদের সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে সজাগ ও উৎফুল্ল রাখার জন্য এই ঔষধের ব্যবহার শুরু করে। জার্মানির এক নায়ক এডলফ হিটলার তার সৈন্যদের দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধে টিকিয়ে রাখার জন্য ‘পারভিটিন’ নামে পরিচিত এই ঔষধ তৈরির নির্দেশ দেন।

 

আর যুদ্ধের পর, ইয়াবা থাইল্যান্ডে প্রকাশ্যে বিক্রি হতে শুরু করে। ট্রাক চালকরা দীর্ঘ রাতের ড্রাইভিংয়ের ক্লান্তি দূর করতে নিয়মিত এটি সেবন করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ইয়াবার প্রভাবে বেশ কিছু ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এর ফলে, ১৯৭০ সালে থাই সরকার ইয়াবার বিক্রয় ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়।

 

কিন্তুু নিষেধাজ্ঞার পরও, ইয়াবা উৎপাদন ও চোরাচালান থেমে থাকে না। বর্তমান সময়ে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় মাদকে পরিণত হয়েছে। এর মারাত্মক প্রভাব, যার মধ্যে রয়েছে আসক্তি, মানসিক ব্যাধি, এমনকি মৃত্যুও, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ধ্বংস করে চলেছে।

ইয়াবা কিভাবে আমদের শরীরকে ধ্বংস করে?

ইয়াবা, যা মেথাম্ফেটামিন নামেও পরিচিত, এটি একটি মাদকদ্রব্য যা দ্রুত মানসিক উত্তেজনা ও প্রফুল্লতার অনুভূতি প্রদান করে। কিন্তু এই সাময়িক আনন্দের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি ভয়ঙ্কর সত্য, সেটি হলো ইয়াবা আমাদের শরীরকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে। চলুন এবার ইয়াবা কিভাবে আমাদের শরীরকে ধ্বংস করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

০১) মস্তিষ্কের ক্ষতি

ইয়াবা মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ বৃদ্ধি করে। ডোপামিন হলো আনন্দ ও প্রেরণার জন্য দায়ী। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে মস্তিষ্ক ডোপামিনের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে ডোপামিন নিঃসৃত হলেও মস্তিষ্ক তা অনুভব করতে পারে না। এর ফলে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা, মনোযোগ হারানোর মতো সমস্যা দেখা দেয়।

 

ইয়াবা মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কিত অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মনোযোগ ধরে রাখতে অসুবিধা, নতুন তথ্য শেখা কঠিন হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও ইয়াবা মনোবিকারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে যাদের পারিবারিক ইতিহাসে মনোবিকার আছে তাদের জন্য ইয়াবা অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, প্যারানোইয়া ইত্যাদি মনোবিকার দেখা দিতে পারে।

০২) রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের ঝুঁকি

ইয়াবা সেবনের সাথে সাথেই রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। দ্রুতগতিতে প্রবাহিত রক্ত হৃৎপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে রক্তনালী গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে হৃদরোগ, স্ট্রোক এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

 

ইয়াবা আমাদের শরীরের অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের অন্যতম কারণ, যা অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (AFib) নামক একটি গুরুতর অবস্থার দিকে ধাবিত করে এবং AFib স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ইয়াবা LDL (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে এবং HDL (ভাল) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে পারে। আর এই মাদক উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

০৩) শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা

ইয়াবায় থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ গুলো সরাসরি ফুসফুসের কোষ গুলোকে আক্রমণ করে, ফলে কোষ গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে মারা যায়। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা সেবনের ফলে ফুসফুসে কালচে দাগ তৈরি হতে পারে, যা এম্ফিজিমা নামক রোগের সূচনা করতে পারে।

 

ইয়াবা সেবন ফুসফুসের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা সেবনের ফলে ব্রঙ্কাইটিস ও ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) এর মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

 

এই ইয়াবা ব্যবহারকারীদের ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। ইয়াবার ধোঁয়া ফুসফুসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে, যার ফলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়। নিউমোনিয়া, টিউবারকুলোসিস এবং ব্রঙ্কাইটিসের মতো গুরুতর সংক্রমণ ইয়াবার কারণে দেখা দিতে পারে।

০৪) লিভার ও কিডনির ক্ষতি

ইয়াবার মধ্যে থাকা মেথাম্ফেটামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ লিভারের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এটি লিভারের কোষ গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। দীর্ঘমেয়াদী ইয়াবা সেবনের ফলে লিভার ফেইলিওরও হতে পারে, যা প্রাণঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

 

কিডনির ক্ষেত্রেও ইয়াবার ক্ষতিকর প্রভাব একই রকম। ইয়াবার মূল উপাদান মেথাম্ফেটামিন কিডনির রক্তনালী গুলো কে সংকুচিত করে, যার ফলে কিডনিতে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে কিডনির কোষ গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পায়। দীর্ঘমেয়াদী সেবনের ফলে কিডনি ফেইলিওরও হতে পারে।

০৫) প্রজনন ক্ষমতার অবক্ষয়

পুরুষদের ক্ষেত্রে, ইয়াবার প্রভাব পড়ে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গতিশীলতার উপর। নিয়মিত ইয়াবা সেবন শুক্রাণুর সংখ্যা কমিয়ে দেয়, যার ফলে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, ইয়াবা শুক্রাণুর গতিশীলতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে ডিম্বাণুতে পৌঁছাতে তাদের সময় লাগে এবং গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়।

 

মহিলাদের ক্ষেত্রে, ইয়াবার প্রভাব পড়ে ঋতুচক্রের উপর। নিয়মিত ইয়াবা সেবন ঋতুচক্র অনিয়মিত করে দেয়, যার ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হওয়ার সময় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও, ইয়াবা গর্ভাশয়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে, যার ফলে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়।

০৬) মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

ইয়াবার প্রভাবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। মাদকের প্রভাবে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ পেলেও, দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা যেমন, আশাহীনতা ও একাকীত্বের অনুভূতি দেখা দেয়।

 

নিয়মিত ইয়াবা সেবন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা ক্রমশ বিভ্রম ও মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যা ‘সাইকোসিস’-এর দিকে ধাবিত করে। এই অবস্থায় ব্যক্তি বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

 

ইয়াবার প্রভাবে আত্ম-সম্মান ও আত্মবিশ্বাস হ্রাস পায়। বিষণ্ণতা ও হতাশার কারণে আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসতে পারে। মাদকাসক্তরা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে লিপ্ত হয়, যা তাদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তোলে।

০৭) সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

ইয়াবা ব্যবহারকারীদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে।  মাদকের নেশায় তারা একবারে অসামাজিক হয়ে পড়ে, পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সাথে তাদের যোগাযোগ কমে যায়।  এর ফলে পারিবারিক অশান্তি, ঝগড়া, এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটতে পারে।

 

আর বর্তমান সময়ে ইয়াবার দাম বেশি, আর নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত মাদক সেবনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। এর ফলে তাদের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়। তারা ঋণের বোঝা নেয়, এমনকি চুরি, ডাকাতির মতো অপরাধের জগতে জড়িয়ে পড়ে।

ইয়াবা আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়

“ইয়াবা”, এক নামে একটি ভয়ঙ্কর বিষ! তরুণ প্রজন্মের মাদকাসক্তির মূল কারণ হিসেবে পরিচিত এই ক্ষতিকর মাদক, ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয় জীবনের সকল সুখ, শান্তি, সম্মান। তাই এবার আমি আপনার সাথে কার্যকরী কিছু ইয়াাবা আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় শেয়ার করবো। যেগুলো অনুসরন করার মাধ্যমে আপনি একজন মানুষের ইয়াবা আসক্তি দুর করতে পারবেন। 

ধৈর্য্য ধরুন

ইয়াবার কালো ছায়া বর্তমান সমাজের এক ভয়াবহ বাস্তবতা। তরুণ প্রজন্ম এই মাদকের কবলে পড়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কারণ ইয়াবা আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তার জন্য শুধু প্রয়োজন ধৈর্য্য, দৃঢ় প্রত্যয় এবং নিয়মিত চিকিৎসা। 

 

তবে ইয়াবা আসক্তি দুর করতে হলে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি, মানসিক থেরাপি, শারীরিক পুনর্গঠন – এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হবে। প্রলোভন, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা, পরিবার ও সমাজের তীব্র সমালোচনা – এসবের মুখোমুখি হতে হবে। 

 

কিন্তু হাল ছাড়বেন না। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। মনে রাখবেন, আপনি একা নন বরং আপনার পাশে আছে পরিবার, বন্ধু, থেরাপিস্ট এবং অনেক মানুষ যারা এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিন, তাদের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যান। তবেই আপনি ইয়াবার আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন।

পারিবারিক সহায়তা

ইয়াবার বিষাক্ত ছায়া থেকে মুক্তি পেতে পরিবার ও সমাজের সহায়তা অপরিহার্য। একজন আসক্ত ব্যক্তির জন্য এই লড়াই একা একাই লড়াই করা অসম্ভব। পরিবার ও সমাজের সহানুভূতি, সমর্থন এবং সহযোগিতাই তাদের এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

 

ইয়াবা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। এই সময় তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করা এবং তাদের সাহস জোগানো গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যদের তাদের নিয়মিত চিকিৎসায় যেতে উৎসাহিত করা উচিত এবং তাদের পুনর্নিবাসনের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা উচিত।

নতুনভাবে জীবনযাপন করা

প্রথম পদক্ষেপ হলো পুরনো বন্ধুদের সাথে বিচ্ছেদ করতে হবে। যারা আপনাকে এই অন্ধকারে টেনে নিয়েছে, তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করুন। নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হবেন, ইতিবাচক মনের মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলবেন। তাদের সঙ্গ পেলে মন হালকা হবে, তখন সবকিছু নতুন করে ভাবতে পারবেন।

 

অতিরিক্ত অবসর সময় আসক্তির মূল কারণ। তাই নতুন নতুন শখ, খেলাধুলা, স্বেচ্ছাসেবক কাজের মাধ্যমে সময় কাটাবেন। বই পড়ুন, গান শুনুন, আঁকুন, নাচুন – যা কিছু আপনার ভালো লাগে সেটাই করুন। নতুন অভিজ্ঞতা আপনার মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবে, যা ইয়াবার কথা ভুলতে সাহায্য করবে।

 

নিয়মিত ব্যায়াম করুন। শরীরচর্চা মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নামক রাসায়নিক নিঃসরণ করে, যা মনকে ভালো রাখে। সেইসাথে সুষম খাদ্য গ্রহণ করবেন। প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি, শস্য খাবেন। এই খাবার গুলো মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীরকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে।

থেরাপি নিন

ইয়াবা আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চাইলে কেবল মাদক সেবন বন্ধ করা যথেষ্ট নয়। দীর্ঘস্থায়ী পুনরুদ্ধারের জন্য মানসিক চিকিৎসা বা থেরাপি অপরিহার্য। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) হল ইয়াবা আসক্তি মোকাবেলায় একটি কার্যকর থেরাপিউটিক পদ্ধতি। CBT-এর মাধ্যমে, আসক্ত ব্যক্তিরা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, যা প্রায়শই তাদের মাদক সেবনের দিকে ধাবিত করে।

ইয়াবা আসক্তি প্রতিরোধে ডিটক্সিফিকেশন

ডিটক্সিফিকেশন হল শরীর থেকে মাদকের প্রভাব দূর করার একটি প্রক্রিয়া। এটি একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে করা হয়। এই প্রক্রিয়ায়, রোগীর শরীর থেকে মাদক এবং এর বিপাকজাত পদার্থ গুলো নির্মূল করা হয়।

 

ইয়াবা শরীরে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। ডিটক্সিফিকেশন এই ক্ষতিকর প্রভাব গুলো থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে এবং আসক্তির চিকিৎসার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করে।

 

ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন ধরে চলে। এই সময়ের মধ্যে, রোগীকে তত্ত্বাবধানে রাখা হয় এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া শুরুর দিকে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে, তবে এটি একটি নিরাপদ এবং কার্যকর পদ্ধতি।

অভিজ্ঞ পেশাদারের সাহায্য

একজন অভিজ্ঞ পেশাদার আপনার আসক্তির পেছনের মূল কারণ বের করার সাহায্য করতে পারবেন। এটি আপনাকে আপনার আসক্তির সাথে আরও ভালভাবে লড়াই করতে এবং পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। একজন পেশাদার আপনার নির্দিষ্ট চাহিদা অনুসারে একটি ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবেন। যে পরিকল্পনায় থেরাপি, সহায়তা গোষ্ঠী, ঔষধ এবং অন্যান্য উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

সচেতনতা বৃদ্ধি

বর্তমানের উন্নত জীবনে, অনেকেই মানসিক চাপ ও হতাশার জালে জড়িয়ে পড়েন। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির আশায় অনেকেই ভুল পথে পা রাখেন, যার মধ্যে অন্যতম হল ইয়াবা। মেথাম্ফেটামিন ও ক্যাফিনের মিশ্রণে তৈরি এই মাদকদ্রব্য, ক্ষণিকের সুখের বিনিময়ে আমরা দান করি জীবনের অমূল্য সময়, স্বাস্থ্য, এমনকি জীবন পর্যন্ত।

 

ইয়াবা আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই জরুরি হলো নিজের ভেতরে সচেতনতা জাগ্রত করা। বুঝতে হবে এই বিষাক্ত মাদক কতটা ক্ষতিকর, এর প্রভাবে কীভাবে জীবন ধ্বংস হচ্ছে। মনে রাখবেন, ইয়াবা কেবল শারীরিক ক্ষতি করে না, বরং মানসিকভাবেও ভেঙে ফেলে।

 

তাই সচেতনতার পাশাপাশি, পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে, এই কঠিন লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। সেজন্য লজ্জা ও ভয় ত্যাগ করে তাদের কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না।

ইয়াবা আসক্ত মানুষের প্রতি আপনার করনীয় কী?

ইয়াবা, বর্তমান সময়ের ভয়ঙ্কর মাদক, যা ধীরে ধীরে আমাদের সমাজের যুব সম্প্রদায়কে গ্রাস করে নিচ্ছে। আসক্তদের চোখে জ্বলে ওঠে অন্ধকার, জীবন হারিয়ে ফেলে তারা পড়ে যায় উদ্দেশ্যহীনতায়। কিন্তু, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা, সমাজের সচেতন সদস্য হিসেবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাদের পুনর্বাসনের আলো দেখাতে পারি।

 

তাই সবার প্রথমে আমাদের ইয়াবার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং গণমাধ্যমকে একসাথে কাজ করতে হবে এই অভিশাপ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করার জন্য। এছাড়াও আমাদের ইয়াবা আসক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদেরকে ঘৃণা বা তিরস্কার করার পরিবর্তে, বুঝতে হবে তাদের দুর্বলতা, তাদের ভেঙে পড়া জীবন। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবই তাদের পুনর্বাসনের পথ সুগম করবে। 

 

আসক্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত আধুনিক ও মানসম্মত পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মনোবিদের তত্ত্বাবধানে আসক্তরা মুক্তি নিতে পারবে। সমাজে তৈরি করতে হবে ইতিবাচক পরিবেশ। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, পারিবারিক অশান্তি – এসবই মানুষকে মাদকের দিকে ধাবিত করে। তাই, সমাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে আমরা মাদকাসক্তির ঝুঁকি কমাতে পারবো।

 

এর পাশাপাশি আমাদের ইয়াবাতে আসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের পর তাদের পুনর্বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাদেরকে সমাজের একজন স্বাভাবিক সদস্য হিসেবে ফিরে আসতে সাহায্য করতে হবে।

 

আমাদের বুঝতে হবে যে, ইয়াবা আসক্তি কেবল একজন ব্যক্তির সমস্যা নয়, এটি সমাজের সমস্যা। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই ভয়ঙ্কর মহামারীকে মোকাবেলা করতে। আসুন, আমরা সকলেই হাত মিলিয়ে কাজ করি, গড়ে তুলি একটি মাদকমুক্ত, সুন্দর সমাজ।

ইয়াবা আসক্তি নিরাময়ে রিহ্যাব সেন্টার গুলোর ভুমিকা কী?

ইয়াবার নেশা, যেন এক অন্ধকার ভয়াল জাল, যেখানে আটকে পড়ে অনেকেই হারিয়ে ফেলে জীবনের সঠিক পথ। তবে মাদকের এই মহামারীতে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয় রিহ্যাব সেন্টার গুলো। রিহ্যাব সেন্টার কেবল চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকা নয়, বরং এটি মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। এখানে ডাক্তার, থেরাপিস্ট, কাউন্সেলরদের এক দক্ষ টিম মিলে কাজ করে আসক্তদের শারীরিক ও মানসিক পুনর্বাসন ঘটানোর জন্য।

 

রিহ্যাব সেন্টারে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে শরীর থেকে মাদকের বিষাক্ত পদার্থ দূর করা হয়। শারীরিক নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার পর শুরু হয় আসল চিকিৎসা। থেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলরদের মাধ্যমে আসক্তির মূল কারণ বের করে তার সমাধান করা হয়। ইয়াবার উপর নির্ভরশীলতা ছাড়া নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য রিহ্যাব সেন্টারে বিভিন্ন কারিগরি দক্ষতা শেখানো হয়।

 

আর রিহ্যাব সেন্টার কেবল ব্যক্তিকে মাদকমুক্তই করে না, বরং পরিবার ও সমাজের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। তো রিহ্যাব সেন্টার ইয়াবা আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে, শুধু রিহ্যাবে ভরসা রাখলেই হবে না বরং রোগীর নিজের ইচ্ছাশক্তি এবং পরিবারের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

পরিশেষে আমাদের কিছুকথা

যদি আপনার পরিবার কিংবা আপনার কোনো প্রিয়জন ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদকে আসক্ত হয় তবে অবশ্যই তাকে ফেরানোর চেষ্টা করবেন। যেন, সে আমাদের মতো স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে পারে। আর সেই লক্ষ্যে আজকের এই আর্টিকেলটি লেখা হয়েছে। আশা করি, আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য অনেক হেল্পফুল হবে। আর যদি আপনি এমন ধরনের অজানা তথ্য বিনামূল্যে জানতে চান তাহলে Omega Point BD এর সাথে থাকবেন।