ইড, ইগো এবং সুপার ইগো।

সিগমান্ড ফ্রয়েড,

ব্যক্তিত্বের গঠন বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি উপাদান বা স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন।

ইড, ইগো এবং সুপার ইগো।

‘ইড’ হচ্ছে ইচ্ছা বা চাওয়া। ‘ইগো’ মানে যুক্তি দিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলা। ‘সুপার ইগো’ হলো আদর্শ বা মোরাল বা বিবেক। ইড জন্ম থেকেই তৈরি হয়। ফ্রয়েড বলছেন, ইগো আসে ইড থেকেই। সবশেষে সুপার ইগো। অর্থাৎ প্রথমে ইচ্ছা, তারপর যুক্তি এবং সবশেষে বিবেক।

একটি শিশুর কথা ভাবুন, শিশু কিছু একটা চাইতেই পারে। সেটি পাওয়া যাবে কি না বা চাওয়া উচিত হবে কি না তা তার জানার কথা নয়। জানার প্রয়োজনও নেই। শিশুটি কিছুদিন পর বুঝবে, চাওয়া যাবে কিন্তু সেই চাওয়াটা পূরণের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না! অর্থাৎ যুক্তি। সবশেষ হলো, ‘সুপার ইগো’। শিশুটি যখন ভাবতে শিখছে, চাওয়াটা উচিত কি না। যদি বিষয়টিকে ক্ষুধা দিয়ে বিচার করি তবে দেখা যাবে, ক্ষুধা লেগেছে খাবার চাইব, ইড। খাবার সামনে আছে সুতরাং পাওয়া যাবে, খাবার নেই সুতরাং পাওয়া যাবে না, এটি ইগো। ক্ষুধা লেগেছে, খাবার আছে, কিন্তু খাবারটি আমার নয়। অন্য কোনো মানুষের, এখানে চাওয়া উচিত নয়। সুপার ইগো। প্রথমে শুধু চাওয়া বা ইচ্ছা, তারপর যুক্তি এবং সবশেষে আদর্শ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিত্ব এভাবেই গড়ে ওঠে। অদ্ভুত এবং দুঃখের বিষয়টি হলো নেশার কারণে সেই গঠনটি আবার উল্টো দিক থেকে নষ্ট হতে থাকে। প্রথমে, আদর্শ নষ্ট হয়। তারপর যুক্তি নষ্ট হয়! থাকে শুধু চাওয়া বা ‘ইড’। নেশাগ্রস্ত বা মাদকাসক্ত মানুষ, যুক্তি দিয়ে বা আদর্শ দিয়ে কিছু বিচার করতে পারে না। মাদকাসক্তির সময় এবং নেশার পরিমাণ যত বাড়তে থাকে, ততই আদর্শ ও যুক্তি ছিঁড়ে যেতে থাকে। থাকে শুধুই নেশার জন্য আকুতি।

মানুষ বড় হতে হতে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাজার রকমের শিক্ষা নিয়ে বড় হয়। নেশার কারণে যখন সে শিক্ষা নষ্ট হতে বসে কিংবা সে শিক্ষা প্রায় শূন্য হতে চলে, নিশ্চয়ই কোনো অভিভাবকের জন্য এটি কোনো সুখের বিষয় নয়। বিষয়গুলো কিছুতেই মানার মতোও নয়। সেটা মৃদু কিংবা প্রকট যাই হোক না কেন। ভেবে দেখুন, ছোটকাল থেকে চলে আসা শিক্ষা বা আদর্শ আর কার্যকর নয়। তখন সে মানুষটির আর থাকলোইবা কী? এমন একটি মানুষের পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অভিভাবক হতেইবা কার ভালো লাগবে? তাই এমন অস্বস্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই তা ঠেকিয়ে দিতে হবে।

বিজ্ঞান বলে, নেশা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যা একবার শুরু হলে বারবার ঘুরেফিরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং কেউ মাদকাসক্ত হওয়ার আগে তা ঠেকিয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম। আর এর জন্য অভিভাবকদেরই সবচেয়ে বেশি সজাগ থাকতে হবে। পরিণত হওয়ার সময় থেকেই, ছেলে বা মেয়েটিকে মাদকের ভয়াবহতা

ও পরিণাম সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে হবে। কে কিভাবে এসবের ভেতর জড়িয়ে যেতে পারে, কিভাবে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হবে সে সম্পর্কে সতর্ক করে তুলতে হবে।

মাদকসেবীরা সাধারণত দুটি কারণে মাদক গ্রহণ করা শুরু করে বলে বিভিন্ন গবেষক উল্লেখ করেছেন। একদল আছে, যারা নিজেদের বিভিন্নভাবে প্রকাশ করতে বা নিজেদের ভালোলাগার অনুভূতিগুলোকে চাঙ্গা করে অন্যদের সঙ্গে মজা করতেই মাদক নেওয়া শুরু করে। এ দলের বেশির ভাগই মনে করে, তারা কোনোভাবেই আসক্ত হবে না। কিন্তু তারা তাদের এই প্রতিজ্ঞা মাঝপথেই হারিয়ে ফেলে। সাধারণত এ দলের মানুষগুলো কম বয়সী হয়। আরেক দলের কথা বলা হয়, যারা কোনো দুঃখ, কষ্ট, মানসিক চাপ, মানসিক রোগ বা দুঃসময়কে সাময়িকভাবে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই মাদক নিতে শুরু করে। কিন্তু তারাও আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। অজান্তেই নেশার মোহময় জালে জড়িয়ে পড়ে।

ব্রেইন-এ ডোপামিন নামের একটি কেমিক্যাল বা নিউরোট্রান্সমিটার আছে। মানুষের যেকোনো আনন্দ-অনুভূতির জন্য এই ডোপামিনই সবচেয়ে বেশি দায়ী। খাওয়া, গাওয়া, ফুর্তি সব কিছুর পেছনেই এই ডোপামিন দায়ী। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মাদক (ডোপামিন বা সেরোটনিনের মতো কেমিক্যালগুলোকে পরিবর্তন করতে করতে) মানুষের ব্রেইনের বেশ কিছু সার্কিট বা চক্রকে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে দেয়। আনন্দ ও মোটিভেশন, এ দুটি চক্র বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নেশার মাধ্যমে, বারবার আনন্দ পাওয়ার বিষয়ে মানুষটি অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। আনন্দ পাওয়ার চক্রটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে কারণেই মানুষ নেশা ছাড়তে পারে না এবং অভ্যাসগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। মানুষ প্রাথমিকভাবে নিজের ইচ্ছায় মাদক নিলেও, ব্রেইনের এসব পরিবর্তনের ফলে এবং শারীরিক বিভিন্ন ক্ষতি হওয়ার পরও বাধ্য হয় বারবার নেশাবস্তু গ্রহণ করতে। দুঃখজনক হলো, মাদক ব্রেইনের কাঠামোগত ও ফাংশনাল/কার্যক্ষমতা দুই ধরনের পরিবর্তনই করে থাকে। ফলে মানুষের আচরণেও পরিবর্তন আসে। সুতরাং আবার কথা হচ্ছে, এসব পরিবর্তন হওয়ার আগেই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। ইয়াবা বা এ জাতীয় কিছু কিছু নেশাবস্তু আছে, যারা ব্রেইনের ডোপামিন বহনকারী নিউরনের গঠন পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

মাদকাসক্তি শুধু ব্রেইনই নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত আরো অনেক ক্ষতিই করতে পারে। একজন মানুষ যখন নেশা করতে করতে তার নিজের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে শুধু নেশার টানের পেছনেই ছুটতে হয়, তখন তার পরিণতি কী হতে পারে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। ব্যক্তি হিসেবে মানুষটির যত ধরনের ইনভল্বমেন্ট আছে সব জায়গাই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভয়াবহ বিষয় হলো, সেসবের বেশিরভাগ সম্বন্ধেই সে লোকটির কোনো অনুভূতি কাজ করে না। বরং সব কিছুকেই গ্রাস করে নেয় নেশার প্রয়োজনীয়তা। ছাত্র হিসেবে, সন্তান হিসেবে, ভাই-বোন হিসেবে, স্বামী হিসেবে, বাবা কিংবা মা হিসেবে, অফিস কিংবা ব্যবসার কর্মী হিসেবে, সামাজিক মানুষ হিসেবে কোথাও মানুষটির তার অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। নেশার উপাদান জোগাড় করতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলা, টাকা সরানো বা চুরি করা, জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়া, মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতারণা করা, ছিনতাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াতে দেখা যায় প্রচুর। অনেকে এমনকি ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কোথায় ঘুম, কোথায় খাওয়া তারও কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না।

ঘরে-বাইরে সবখানে এমন হাজার ধরনের বিশৃঙ্খলা, যখন তখন ক্ষেপে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া বা অসময়ে ঘুমিয়ে থাকা, যৌন সমস্যা, মানুষের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্কের অবনতি নেশার খুব সাধারণ পরিণতি। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের চামড়া পর্যন্ত সবখানেই নেশা ছোবল দিতে পারে। স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, লিভার, কিডনি, ফুসফুস সব অঙ্গ এমনকি ফেইল পর্যন্ত করতে পারে। নেশার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সরাসরি জড়িত, সুতরাং মানসিকবিষয়ক যেকোনো ধরনের ক্ষতিই নেশার কারণে হতে পারে। চাকরি বা কর্মহীনতা, নেশার পেছনে অর্থ জোগাড়, শারীরিক চিকিৎসা বা বারবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়াসহ প্রত্যেকটি পদে পদে মানুষকে অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বও বরণ করতে হয়।

অথচ অপ্রয়োজনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত এমন একটি বিষয় মানুষ দিন দিন বয়ে নিয়ে চলছে। মানুষই মানুষের এই ক্ষতি করে চলছে প্রতিদিন। নেশা যারা বানায়, নেশা যারা বিক্রি করে, তারা সবাই জানে বিষয়টি ঠিক নয়। জেনেশুনে বুঝেই অন্যের ক্ষতি করার এই প্রবণতা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর ভেতর আছে কি না জানি না। মানুষকে এবং প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য নেশার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া একটি কৌশলও বটে। স্বইচ্ছায় বা অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নেশার ভেতর ঢুকে যাওয়ার আগেই আপনার সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন। তা নাহলে আপনিও এর জন্য দায়ী মনে রাখতে হবে। ব্রেইনের যে অংশ (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) যুক্তি বা বিভিন্ন হিসেব-নিকেশের কাজে ব্যবহৃত হয়, কম বয়সীদের সে অংশ পূর্ণভাবে পরিণত হয় না। বরং তাদের আবেগ নির্ভরঅংশই (ব্রেইনের এমাগডেলা) বেশি অ্যাকটিভ থাকে। সুতরাং যুক্তি দিয়ে তারা হয়তো সব সময় বিচার করতে পারে না। সে কারণেও অভিভাবকের দায়িত্ব আরো বেশি থেকে যায়।